নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ উপাধ্যক্ষসহ ১৬ জন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আছেন। প্রভাব খাটিয়ে তাঁদের ডিঙিয়ে পাঁচ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন একজন প্রভাষক। এ ঘটনা বরিশাল সিটি কলেজের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিশ্ববিদ্যালয় চিঠি দিয়ে ওই শিক্ষককে পদ ছেড়ে বিধি মোতাবেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে দায়িত্ব দিতে বলেছে। সেই নির্দেশও ওই শিক্ষক মানেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
সিটি কলেজ অবস্থিত বরিশাল নগরের সদর রোডে। এই কলেজে অধ্যক্ষের পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ২০১৫ সালে কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সুজিত কুমার দেবনাথ নিয়মবহির্ভূতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। কলেজ প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে বরিশাল সিটি কলেজের অধ্যক্ষ অবসরে গেলে পদটি শূন্য হয়। তখন উপাধ্যক্ষ রবীন্দ্র নাথ অধিকারীকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী রবীন্দ্র নাথ অধিকারী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদটি ছেড়ে দেন। কিন্তু একজন নিয়োগপ্রার্থী আদালতে মামলা করায় অধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ১২ জুলাই তৎকালীন পরিচালনা কমিটিকে হাত করে সুজিত কুমার দেবনাথ অন্তর্র্বতীকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদে বসেন। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়ম বলছে, প্রভাষক সুজিত কুমার দেবনাথের ওই দায়িত্ব পাওয়ার যোগ্যতা ছিল না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের ২০১৫ সালের প্রণীত (সংশোধিত) বিধির ৪ এর (ক) ৩ অনুযায়ী, অধ্যক্ষের পদ শূন্য হলে উপাধ্যক্ষ কিংবা প্রথম জ্যেষ্ঠ পাঁচজন শিক্ষকের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিতে পারবে কলেজ পরিচালনা কমিটি। সেখানে সুজিত কুমার দেবনাথ জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে কলেজের ১৭ নম্বর শিক্ষক। তাঁর ওপরে যে ১৬ জন শিক্ষক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৮ জন সহকারী অধ্যাপক। এরপরও তিনি মামলার অজুহাতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদটি পাঁচ বছর ধরে আগলে আছেন। কলেজের উপাধ্যক্ষ রবীন্দ্র নাথ অধিকারী অভিযোগ করে বলেন, সুজিত কুমার দেবনাথ নিয়মবহির্ভূতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে চিঠি দিলেও তিনি পদ ছাড়ছেন না।
তবে সুজিত কুমার দেবনাথ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি এই দায়িত্বের জন্য যোগ্য না হলে কীভাবে দায়িত্বে আছি? মূলত অধ্যক্ষ পদের নিয়োগ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকায় বিষয়টি ঝুলে আছে। আমরা মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা চালাচ্ছি, যাতে পূর্ণাঙ্গ কোনো অধ্যক্ষ নিয়োগ পাওয়ার পর আমি দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারি।’ বিষয়টি জানার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নির্দেশে ২০১৭ সালের ৩১ মে তৎকালীন কলেজ পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শামসুদ্দীন ইলিয়াস একটি আদেশ দেন।
তাতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুজিত কুমার দেবনাথের সই করা কোনো কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, মর্মে উল্লেখ করা হয়। এর আগে সুজিত কুমার দেবনাথকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদ ছেড়ে দিয়ে জ্যেষ্ঠ কোনো শিক্ষকের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই নির্দেশ অমান্য করে তিনি নানা কৌশলে পদটি আঁকড়ে আছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশ অমান্য করার বিষয়ে সুজিত দেবনাথ বলেন, ‘আমাকে যখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তখন সেটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জানা ছিল না। তাই এ ধরনের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। পরে এ বিষয়ে তৎকালীন কলেজ পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তের রেজল্যুশন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর পর বিষয়টি মিটে গেছে।’ এদিকে কলেজের শিক্ষকদের অভিযোগ, সুজিত কুমার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কলেজে প্রশাসনিক কোনো শৃঙ্খলা নেই। কলেজের আর্থিক হিসাব-নিকাশেও কোনো স্বচ্ছতা নেই। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির জন্য জমা করা টাকার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই; কলেজে নেই কোনো ডিমান্ড রেজিস্টার। শিক্ষকদের দলাদলির কারণে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই কলেজের শিক্ষার মানও দিন দিন নি¤œমুখী হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কলেজ পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বরিশাল সিটি কলেজের বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই ঝামেলা চলছে। এ নিয়ে মামলা থাকায় বিষয়টির সুরাহা করা যাচ্ছে না। এতে কলেজটির শিক্ষার মান নিচে নেমে যাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে আমাদের অফিসের কার্যক্রম সীমিতভাবে চলছে। ফলে নথি না দেখে আমি বিস্তারিত বলতে পারব না। তবে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য কলেজ পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি জেলা প্রশাসককে আমরা চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছি।’ বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বলেন, ‘আসলে আমি এই কলেজের অন্তর্র্বতীকালীন (অ্যাডহক) কমিটির সভাপতি। এই কমিটির দায়িত্ব পালনে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। শুধু জরুরি বিষয়গুলো আমাদের এখতিয়ারে আছে। তা ছাড়া যিনি এখন অধ্যক্ষ, তিনি আগের পরিচালনা কমিটির সময় দায়িত্ব পেয়েছেন। আমি মনে করি, কলেজ পরিচালনার নিয়মিত কমিটি হলেই দ্রুত এই সমস্যা সমাধান হতে পারে।’ প্রথম আলো।
Leave a Reply